জীবন কতই না বিচিত্রময়। কেউ কেউ সারাজীবন বসে বসে জীবন পার করছে আবার কেউ কেউ দু-মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করছে। কারো করো সকল ধরনের সুবিধা থাকার পরেও শিক্ষিত হতে পারছেনা আবার কারো কারো জীবন প্রতিকূলতায় পূর্ণ হওয়ার পরেও সুশিক্ষিত হওয়ার সংগ্রামে জয়ী হচ্ছে। সেই জন্যই জ্ঞানী লোকেরা বলে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আমি এখানে এক সংগ্রামী মানুষের জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প আলোচনা করছি এবং সংগ্রামের মাধ্যমে জীবনের পরিবর্তন সাধনের গল্প বলতে যাচ্ছি।
সময়টা ২০১২ সাল, সবেমাত্র সে একটি মাদ্রাসা থেকে জেডিসি পরীক্ষা দিয়েছে। আগেই বলে নিই, সে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। যেখানে ২০১২ সালের সময় এসেও এসএসসি-এর উপরে কোন শিক্ষিত লোক পাওয়া খুবই কঠিন (ছিলোনা বললেই চলে) ছিল। তখন তাদের এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা খুবই কম লোক জানত।
স্কুলে পড়ার সময়, তাদের এলাকায় বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক ছিলোনা। অনেক দূরে গিয়ে প্রাইভেট পড়তে হতো। প্রথম তিনমাস পড়ার পর আর প্রাইভেট চালু রাখতে পারলোনা। তাদের পরিবারে তিনবেলা খাওয়াটাই ছিল চ্যালেঞ্জের, সেখানে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা খরচ করা ছিল ক্ষতের ওপর লবণ ছিটানোর মত। আব্বু তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বলল, কিন্তু সে কোনোমতেই আব্বুর কথাই রাজি হতে পারলোনা। কারণ তাকে ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে।
এভাবেই ২ বছর চলতে চলতে এসএসসি টেস্ট পরীক্ষা চলে আসলো। টেস্ট পরীক্ষায় গণিতে ফেল করলো। তার আব্বু সুযোগ পেয়ে গেল, বারবার বলতে থাকতো এভাবে লেখাপড়া করে পাস করতে পারবিনা, তারচেয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজ কর। এটার জন্য আব্বুকে সে কোনদিন দোষ দেয় নাই। কারণ সেই সময় ঠিকমতো তিনবেলা খাবার পাওয়া ছিল অনেক কষ্টের।
টেস্ট পরীক্ষার পর কাজ করা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত পড়ালেখাতে পড়ে রইলো, যেভাবেই হোক তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। এদিকে আব্বুর পরিবার চালানোর যাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে শুরু হলো। এমন অনেকদিন গেছে একবেলা ভাত খেয়ে অন্যবেলাগুলো পানি খেয়ে পার করতে হয়েছে। এটাতে আব্বুর প্রতি তার কোন অভিযোগ নেই, কারণ এটা ছিল তাদের জন্য বেঁচে থাকার পরিক্ষা। যেখানে তারা সফল হয়েছে।
গ্রামের পরিচিত এক চাচা গাজীপুর গার্মেন্টসে কাজ করত। তার মাধ্যমে তারা একটা বাসা ভাড়া নিলো। তার আব্বু একটি কারখানায় লোডার হিসেবে কাজ শুরু করল। আর সে একটি গার্মেন্টসে হেল্পার পদে কাজ শুরু করলো।
রেজাল্ট পেয়ে খুব ভাল লাগলো। মনে মনে ভাবতে শুরু করলো, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য একধাপ এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সে তখনও জানতোনা যে, ৪.৫৬ রেজাল্টে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়না। এলাকার এক কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলো, কিন্তু ঢাকাতেই থেকে গেলো। বিজ্ঞান শাখার বই কিনলো, এসএসসিতে পড়া পদার্থ বিজ্ঞানের কয়েকটা থিয়োরি ছাড়া বই খুলে কিছুই বুঝতে পারলোনা, আর কেমিস্ট্রির বিক্রিয়াগুলো যেন মাথার ওপর দিয়ে যেত, গণিতের কথা বাদ দেয়ায় ভালো। গার্মেন্টসে কাজ করে পড়ার সময় একদম পেলনা, প্রাইভেটের চিন্তাতো কল্পনাই করা যায়না।
অবশেষে প্রায় ৬ মাস পরে বিজ্ঞান বিভাগ পরিবর্তন করে সে মানবিক বিভাগে আসলো। জীবন থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। তখন সে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলো যা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। কতরাত যে কেঁদেছে তা বলা কষ্টের। যখন পরকিল্পনা ভেঙ্গে গেলো লেখাপড়া করে কি হবে, এই কথা ভেবে প্রায় লেখাপড়া ছেড়ে দিলো। তখন লেখাপড়ার অস্তিত্ব বলতে শুধু কলেজে ভর্তি হওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
২০১৬ সালের জুলাই মাসের দিকে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গাজিপুরের জয়দেবপুরে একটি কোম্পানিতে সেলস্-ম্যান হিসেবে নতুন চাকরি শুরু করলো। সেখানের বেতন প্রায় ১৪ হাজারের মতো ছিল। সে বেতন বেশি পাওয়ায় পরবিারকে গাজিপুর থেকে বাসায় চলে যেতে বলল। প্রতিমাসে তার খরচ রেখে বাকি টাকা বাসায় পাঠিয়ে দিতো। তখনতো সে লেখাপড়া করবে এমন কোন ইচ্ছাই ছিলোনা।
সে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাড়িতে ফোন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার পরিকল্পনা জানায়। আব্বু তাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিতে সাহস যুগিয়েছিল। আর সে গাজিপুর যাওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে অল্প অল্প করে প্রায় ৫২ হাজার টাকার মতো জমিয়েছিলো। ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে আসল এবং লেখাপড়া পুরোদমে শুরু করলো। সে এইসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী একটি কোচিংয়ে ভর্তি হয়। ঐ কোচিংয়ের সিস্টেম ছিলো ১৫০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। যদি কোথাও চান্স পায় তবেই অতিরিক্ত ৮০০০ টাকা নেবে নয়তো কোন টাকা নেবেনা।
৪ মাস পর এইসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হলো, মাত্র প্রায় ২ মাসের প্রস্তুতিতে ৪.৭৫ রেজাল্ট হওয়ায় তার আব্বু আম্মু অনেক খুশি হয়েছিলেন। আর তার নিজের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে গেলো সে নিজেকে বোঝাতে শুরু করলো বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্যই তৈরি করা হয়েছে, তাকে সেখানে যেতে হবেই।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পুনরায় সমস্যা শুরু হয়। ইতিমধ্যে তার জমানো টাকা অ্যাডমিশনে খরচ হয়ে গিয়েছে। তার পরিবার ঠিক আগের অবস্থায় আছে শুধুমাত্র কিছু দেনা কমেছে। তখন সে বুঝতে পারলো তার লেখাপড়া চালু রাখতে হলে তাকে কিছু করতে হবে। রংপুরে তেমন কিছু নেই যেখানে পার্টটাইম কাজ করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরো রংপুর সে পার্টটাইম কাজ খুঁজেছে কিন্তু কোথাও পায়নি। মেসের টাকাও ঠিকমতো দিতে পারতোনা, যার ফলে খরচ কমাতে দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে থাকতো। মাসের বেশিরভাগ দিন রোজা রেখে পার করতো।
সে এক বড় ভাইয়ের সাথে বিষয়টা শেয়ার করলো, তিনি টিউশান ঠিক করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফাস্ট ইয়ারে পড়া ছাত্রদের গার্ডিয়ানরা টিউশান দিতে চাননা। ফাস্ট ইয়ারে টিউশান পেলো না। এইদিকে বাড়ি থেকে খুব কষ্টে টাকা পাঠায় সে বাড়ির অবস্থা ভালোভাবেই জানতো সাথে এটাও জানতো যে, টাকা আয় করা কত কঠিন কাজ।
মোরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্টের পক্ষ থেকে স্বাবলম্বী প্রজেক্টের ব্যবস্থা করে, সেখানে সে বই সেলার হিসেবে আবেদন করে। মোরাল প্যারেন্টিং-এর মাধ্যমে এক দয়াবান ব্যক্তি তাকে এককালীন ৭০০০ টাকা দেয়। এক বছরে সে সেই টাকাকে ৩০,০০০ টাকায় রুপান্তর করে এবং সেই টাকা দিয়ে ডেস্কটপ কম্পিউটার বানিয়ে নেয়। তার ছোট বেলার স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার লক্ষে। যদিও প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সম্ভব কিনা সে জানেনা, তবে কম্পিউটার বিষয়ে তার আগ্রহ অনেক বেশি।
সে ইতঃমধ্যে মাইক্রোসফট এপ্লিকেশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন বেসিক শিখেছে এবং ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে যেকোন ধরণের সাইট তৈরি করতে পারে। এন্ডোয়েড এপ্লিকেশন তেরি করার জন্য” কটলিন” ভাষা শেখার চেষ্টা করছে।
জীবনে কষ্ট করলে আল্লাহ তার প্রতিদান অবশ্যই দান করবেন। কষ্ট দেখে হতাশ হলে চলবেনা, জীবনে লক্ষ নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। কখনোই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা।